বিনা পয়সায় জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে উল্লাপাড়ার মালেকা বেগম
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি :
প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই শিশুরা বই-খাতা নিয়ে দল বেঁধে পড়তে আসে ডেফলবাড়ি জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়ে। এখানে তারা শেখে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের প্রাথমিক পাঠের পাশাপাশি শেখে পবিত্র কোরআন পাঠ। শুধু শিশুরাই নয়, জ্ঞানের আলো শিক্ষালয় গ্রামের নিরক্ষর গৃহিণীরাও পড়তে আসেন। তাদের সবাইকে বিনা পয়সায় পড়ান মালেকা বেগম। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড়হর ইউনিয়নের ডেফলবাড়ি গ্রামে তার এ শিক্ষালয়। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি এলাকার অনগ্রসর শিশু-কিশোর ও গৃহিণীদের বিনা পয়সায় পাঠদান করে আসছেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডেফলবাড়ি জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এলাকার গৃহবধুরা বাড়ির উঠানে চট পেতে বসে কোরআন পাঠসহ প্রাক-প্রাথমিকের জ্ঞান অর্জন করছে।
শিক্ষার্থীদেরকে মায়ের আদরে পাঠদান করাচ্ছেন গৃহবধু মালেকা বেগম। সেই সাথে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিক্ষাদান করছেন এই গৃহবধু। প্রতিদিন রাত পোহানোর সাথে সাথে ডেফলবাড়ি গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শিশুরা বই খাতা নিয়ে দলবেঁধে চলে আসেন গৃহবধু মালেকা বেগমের বিনা পয়সার জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়ে। জানা যায়, গ্রামের অধিকাংশ বউ ঝিরাও পবিত্র কোরআন পড়তে জানেন না। জানেন না প্রাক-প্রাথমিকের অক্ষর জ্ঞান। মালেকা নিজে ভাল কোরআন শরীফ পাঠ করতে পারেন। তিনি মনস্থির করেন, প্রাথমিক ভাবে শিশু ও বউ ঝিদেরকে তিনি কোরআন শরীফ পাঠ শেখাবেন। তিনি কয়েকটি মাদুর ও চটের ব্যবস্থা করেন। সেই সাথে শুরু করেন নিজ বাড়ির উঠানে কোরআন শিক্ষার কার্যক্রম। শুরু থেকে মালেকা বেগম খোলা আকাশের নিচেই এলাকার শিশু, ও বয়োবৃদ্ধদের শিক্ষা দিয়ে আসছেন।
২০১১ সালে তার ছেলে আবুল হোসেনের উদ্যোগে ডেফলবাড়ী জ্ঞানের আলো শিক্ষালয় নাম করণ করে কুরআন হাদিসের পাশাপাশি প্রাক প্রাথমিক বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও অন্যান্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে আসছেন। গত ১০ বছরে শুরুতে তার এই শিক্ষালয় থেকে দুই শতাধিক শিশু প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে এলাকার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন লেখাপড়া করছে। এই গৃহবধু শিক্ষাদান শুরু থেকেই তার পাঠদানের জন্য কারো কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেন না। আর এভাবেই চলে আসছে তার এই বিনে পয়সার শিক্ষাদান কার্যক্রম। মালেকা বেগম বলেন, প্রায় ৩৬ বছর আগে তার বিয়ে হয় ওই গ্রামের আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি খেয়াল করেন, ফুলজোড় নদী তীরবর্তী ভাঙ্গনকবলিত ডেফলবাড়ি এলাকায় শিশুদের পবিত্র কোরআন শেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রামের নারীদেরও অনেকে কোরআন পড়তে পারেন না।
বিয়ের কয়েক বছর পর তিনি ঠিক করেন, শিশু ও গৃহবধূদের তিনি কোরআন পাঠ শেখাবেন। কয়েকটি মাদুর ও চটের ব্যবস্থা করে তার বাড়ির উঠানেই শুরু হয় কোরআন পাঠ শেখানোর কার্যক্রম। মালেকা বেগমের ছেলে আবুল হোসেন জানান, অভাবের সংসারেও আমার মা শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে কোনো টাকা-পয়সা নেননি। গ্রামের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে চেয়েছেন তিনি। মায়ের এ কাজের জন্য ছেলে হিসেবে আমি গর্বিত। এই শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থী গৃহবধূ আমেনা বেগম বলেন, আমি মালেকা বেগমের কাছে কোরআন পাঠ শিখেছেন। একই সঙ্গে শিখেছি গণিতের প্রাথমিক পাঠ। এখন নিজেই পরিবারের সব খরচের হিসাব রাখতে পারি।
ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন জানান, মালেকা বেগম দীর্ঘদিন ধরে এলাকার পিছিয়ে পড়া হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থী ও তাদের মায়েদেরকে বিনে পয়সায় কোরআন ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে আসছেন। আর তিনি এই শিক্ষা দিয়ে এলাকায় প্রচুর সুনাম অর্জন করেছেন। উল্লপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আরিফুজ্জামান বলেন, ডেফলবাড়ি গ্রামের গৃহবধু মালেকা বেগমের বিনা পয়সায় এই শিক্ষালয়টি এলাকায় বেশ পরিচিত। মালেকা বেগম দীর্ঘদিন ধরে বহু শিশু ও গৃহবধুদের মধ্যে বিনা পয়সায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছেন। এলাকায় সকল মানুষের নিকট তিনি হয়ে উঠেছেন এক আদর্শ শিক্ষিকা। আরিফুজ্জামান মালেকা বেগমকে শিক্ষা বিস্তারের পথিকৃৎ উল্লেখ করে তার শিক্ষা কেন্দ্রের সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।